কেপলার-এর সূত্র

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ১ম পত্র | | NCTB BOOK

অতি প্রাচীনকাল হতে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে ডেনমার্কের জ্যোতির্বিদ টাইকোব্রে (Tycho-Brahe) মংগল গ্রহের গতিবিধি লক্ষ করেন এবং কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। তাঁর এ গবেষণা লব্ধ তথ্য এবং অন্যান্য পর্যবেক্ষণের সাহায্যে 1618 খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের অপর জ্যোতির্বিদ জন কেপলার (John Kepler) সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, গ্রহগুলো কোন এক বলের প্রভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে অবিরাম ঘুরছে। এই সম্পর্কে তিনি তিনটি সূত্র প্রদান করেন। তাঁর নাম অনুসারে এই তিনটি সূত্রকে কেপলার-এর গ্রহ সম্পৰ্কীয় গতিসূত্র (Kepler's laws of planetary motion) বলা হয়। সূত্র তিনটি নিম্নে আলোচিত হল ঃ

(১) উপবৃত্ত সূত্র (Law of ellipse) :

 প্রতিটি গ্রহ সূর্যকে উপবৃত্তের নাভিতে বা ফোকাসে রেখে একটিউপবৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করছে। 

(২) ক্ষেত্রফল সূত্র (Law of area) : 

গ্রহ এবং সূর্যের সংযোগকারী ব্যাসার্ধ রেখা সমান সময়ে সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করে।

(৩) সময়ের সূত্র (Law of time ) :

 প্রতিটি গ্রহের পর্যায়কালের বর্গ সূর্য হতে তার গড় দূরত্বের ঘনফলের সমানুপাতিক।

চিত্র :৭.১৬

ব্যাখ্যা : 

১ম সূত্র : 

এই সূত্র সূর্যের চারদিকে গ্রহের কক্ষপথের আকৃতি প্রকাশ করে। মনে করি S এবং S' একটি উপবৃত্তের দুটি নাভি। ধরি নাভিটি সূর্যের অবস্থিতি [চিত্র ৭.১৬]। কেপলারের প্রথম সূত্র অনুসারে যে কোন গ্রহ সূর্যকে s বিন্দুতে রেখে একটি উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে।

২য় সূত্র :

 এই সূত্র কক্ষীয় বেগ এবং সূর্য ও গ্রহের মধ্যবর্তী দূরত্বের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। মনে করি কোন গ্রহ। সময়ে P অবস্থান হতে Q অবস্থানে আসে। যদি একই সময়ে ঐ গ্রহ M অবস্থান হতে R অবস্থানে আসে, তবে কেপলারের দ্বিতীয় সূত্র হতে পাই, PQS-এর ক্ষেত্রফল এবং MSR-এর ক্ষেত্রফল সমান হবে।

৩য় সূত্র ঃ

 এই সূত্র’গ্রহের কক্ষপথের আকার এবং অতিক্রান্ত সময়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। মনে করি T গ্রহের পর্যায়কাল অর্থাৎ সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে যে সময় লাগে তার মান T। যদি 2a পরাক্ষের দৈর্ঘ্য হয়, তবে কেপলারের তৃতীয় সূত্র হতে আমরা পাই, T28a3

যেহেতু 8 একটি ধ্রুব সংখ্যা, সেহেতু  T2a3

উক্ত সমীকরণ হতে কেপলারের তৃতীয় সূত্রটিকে সামান্য পরিবর্তন করে নিম্নরূপে লিখা যায় -

প্রতিটি গ্রহের পর্যায়কালের বর্গ গ্রহের কক্ষপথের পরাক্ষের অর্ধেকের ঘন-এর সমানুপাতিক।

৭.২০ কেপলারের সূত্র হতে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র প্রতিপাদন 

Derivation of newton's law of gravitation from Kepler's law

মহাবিজ্ঞানী নিউটন কেপলারের সূত্রগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে মহাবিশ্বে যে কোন দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সূর্যের চতুর্দিকে গ্রহগুলোর কক্ষপথ বৃত্তাকার গণ্য করে নিম্নলিখিত উপায়ে সহজে কেপলারের সূত্রগুলো হতে নিউটনের এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। 

ধরা যাক m ভরের একটি গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে ব্যাসার্ধের বৃত্তপথে সমগতিতে ঘুরছে। কিন্তু গ্রহের উপর সূর্যের দিকে কেন্দ্রমুখী বল প্রয়োগ ব্যতীত গ্রহের এই বৃত্তাকার গতি সম্ভব নয়।

প্রয়োজনীয় কেন্দ্রমুখী বল F=mv2r

সূর্যের চতুর্দিকে গ্রহটির আবর্তন কাল T হলে,

<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>v</mi><mo>=</mo><mfrac><mrow><mn>2</mn><mi>π</mi><mi>r</mi></mrow><mi>T</mi></mfrac><mfenced open="[" close="]"><mrow><mi>v</mi><mo>=</mo><mi>ω</mi><mi>r</mi><mo>,</mo><mi>ω</mi><mo>=</mo><mfrac><mrow><mn>2</mn><mi>π</mi></mrow><mi>T</mi></mfrac></mrow></mfenced></math>

<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>F</mi><mo>=</mo><mfrac><mi>m</mi><mi>r</mi></mfrac><msup><mfenced><mfrac><mrow><mn>2</mn><mi>π</mi><mi>r</mi></mrow><mi>T</mi></mfrac></mfenced><mn>2</mn></msup><mo>=</mo><mfrac><mrow><mn>4</mn><msup><mi>π</mi><mn>2</mn></msup><mi>m</mi><mi>r</mi></mrow><mrow><msup><mi>T</mi><mn>2</mn></msup></mrow></mfrac></math>

কিন্তু কেপলারের তৃতীয় সূত্রানুসারে, T2r3

অর্থাৎ T2 = kr3, এখানে k একটি ধ্রুবক।

<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>F</mi><mo>=</mo><mfrac><mrow><mn>4</mn><msup><mi>π</mi><mn>2</mn></msup><mi>m</mi><mi>r</mi></mrow><mrow><msup><mi>T</mi><mn>2</mn></msup></mrow></mfrac><mo>=</mo><mfrac><mrow><mn>4</mn><msup><mi>π</mi><mn>2</mn></msup><mi>m</mi></mrow><mrow><mi>k</mi><msup><mi>r</mi><mn>2</mn></msup></mrow></mfrac></math>

সুতরাং গ্রহের উপর সূর্যের আকর্ষণ বল, গ্রহের ভরের সমানুপাতিক এবং সূর্য হতে গ্রহের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। কিন্তু প্রত্যেক ক্লিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। কাজেই সমীকরণটিতে F-এর সাথে যেমন গ্রহের ভর m-এর সম্পর্ক আছে তদ্রূপ F-এ সূর্যের ভরেরও একই সম্পর্ক থাকবে। এজন্য  <math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mfenced><mfrac><mrow><mn>4</mn><msup><mi>π</mi><mn>2</mn></msup></mrow><mi>k</mi></mfrac></mfenced></math>  -কে GM ধরা যায় ; এখানে G একটি ধ্রুবক এবং M সূর্যের ভর।

সূর্য ও গ্রহের মধ্যকার পারস্পরিক আকর্ষণ বল, F=GmMr2    (33)

এটাই নিউটনের মহাকর্ষীয় সমীকরণ। সুতরাং কেপলারের সূত্র হতে নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্র প্রতিষ্ঠিত হল।

৭.২১ মহাকর্ষীয় ভর এবং জড় ভর

Gravitational mass and inertial mass

পৃথিবী যে বল দ্বারা কোন বস্তুকে টানে তা বস্তুর ভরের সমানুপাতিক। এই ভর মহাকর্ষীয় তর। তুলাদণ্ডের সাহায্যে এই ভর নির্ণয় করা হয়। অন্য কথায় বলা যায়— তুলাদণ্ডে মেপে আমরা যে ভর নির্ণয় করি, তাই মহাকর্ষীয় ভর।

কোন বস্তুতে ধ্রুবমানের F বল প্রয়োগ করলে যদি তার ত্বরণ a হয়, তা হলে Fa=mকে তার জড় তর বলে। পরীক্ষায় দেখা যায় উভয় ভর একই।'

 

৭.২২ মুক্তি বেগ

Escape velocity 

আমরা জানি মহাকর্ষীয় বল কেন্দ্রগ বলে সংরক্ষণশীল। তাই কোন একটি বস্তুকে উপরের দিকে নিক্ষেপ করলে তা আবার মাটিতে এসে পড়ে। কিন্তু কোন বস্তুকে যদি এমন বেগে উর্ধ্বে উৎক্ষেপ করা হয় যে তা পৃথিবীর অভিকর্ষীয় ক্ষেত্র অতিক্রম করে যায় তবে বস্তুটি আর কখনই পৃথিবীর পৃষ্ঠে ফিরে আসবে না। ন্যূনতম এই বেগকে মুক্তি বেগ বলে। অতএব কোন বস্তুকে ন্যূনতম যে বেগে ঊর্ধ্বে উৎক্ষেপ করলে তা আর পৃথিবী পৃষ্ঠে ফিরে আসে না তাকে মুক্তি বেগ বা পলায়ন বেগ বা নিষ্ক্রমণ বেগ বলে। একে VE দ্বারা সূচিত করা হয়।

মুক্তি বেগের সমীকরণ বের করতে গিয়ে ধরি উৎক্ষিপ্ত বস্তুর ভর m, পৃথিবীর ভর M, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R, পৃথিবীর কেন্দ্র হতে বস্তুর দূরত্ব r, [চিত্র ৭.১৭] অতএব বস্তুর উপর অভিকর্ষ বল,

F=GMmr2

এখন বস্তুটি যদি অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে dr পরিমাণ উপরে উঠে, তবে কাজের পরিমাণ, dW = F.dr

F=GMmrdr

সুতরাং অভিকর্ষীয় বল ছাড়াতে বস্তুটিকে মোট যে পরিমাণ কাজ করতে হবে, তার মান

<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>W</mi><mo>=</mo><mo>∫</mo><mi>d</mi><mi>W</mi><mo>=</mo><munderover accent='false' accentunder='false'><mo>∫</mo><mi>R</mi><mi>∞</mi></munderover><mfrac><mrow><mi>G</mi><mi>M</mi><mi>m</mi></mrow><mrow><msup><mi>r</mi><mn>2</mn></msup></mrow></mfrac><mi>d</mi><mi>r</mi></math>

বা, <math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>W</mi><mo>=</mo><mi>G</mi><mi>M</mi><mi>m</mi><munderover accent='false' accentunder='false'><mo>∫</mo><mi>R</mi><mi>∞</mi></munderover><mfrac><mn>1</mn><mrow><msup><mi>r</mi><mn>2</mn></msup></mrow></mfrac><mi>d</mi><mi>r</mi><mo>=</mo><mi>G</mi><mi>M</mi><mi>m</mi><mfenced open="[" close="]"><mrow><mo>−</mo><mfrac><mn>1</mn><mi>r</mi></mfrac></mrow></mfenced><mtable><mtr><mtd><mi>∞</mi></mtd></mtr><mtr><mtd><mi>R</mi></mtd></mtr></mtable></math>

অর্থাৎ,  <math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>W</mi><mo>=</mo><mi>m</mi><mo>×</mo><mfrac><mrow><mi>G</mi><mi>M</mi></mrow><mi>R</mi></mfrac></math>

মনে করি, বস্তুর উৎক্ষিপ্ত বেগ = VE । তা হলে তার প্রাথমিক গতিশক্তি Ek=12mvE2

এই শক্তি ব্যয় করেই বস্তুটি অভিকর্ষীয় ক্ষেত্রের সীমানা ছাড়িয়ে যায় অর্থাৎ উপরোক্ত কাজ করবে।

:- VE=2gR

এটাই হল যুক্তি বেগের সমীকরণ। উপরোক্ত সমীকরণে m না থাকায় আমরা বলতে পারি যে, মুক্তি বেগ বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে না। বস্তু ছোট বা বড় যাই হোক না কেন, মুক্তি বেগ একই হবে।

উদাহরণস্বরূপ ধরা যায়, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ, 

R = 64 x 105m ও g = 9.80 ms-2

অতএব এক্ষেত্রে মুক্তি বেগ,

vE=2×9.80×64×105

     =11.20×103ms-1

     = 11.20Kms-1 = 7 মাইল/সে. (প্রায় )

     = 25000 মাইল/ঘন্টা

চিত্র : ৭.১৮

সুতরাং কোন বস্তুকে যদি প্রতি ঘণ্টায় 25000 মাইল বেগে বা এর অপেক্ষা অধিক বেগে উৎক্ষেপ করা হয়, তবে তা আর ভূ-পৃষ্ঠে ফিরে আসে না।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য : পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে কোন বস্তুকে বেগে উপর দিকে নিক্ষেপ করলে পৃথিবীর আকর্ষণ বলের দ্বারা বস্তুটির বিভিন্ন পরিণতি হতে পারে। যথা ঃ

 (১) যদি  <math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><msup><mi>v</mi><mn>2</mn></msup><mo><</mo><mfrac><mrow><msub><msup><mi>v</mi><mn>2</mn></msup><mi>E</mi></msub></mrow><mn>2</mn></mfrac></math> - হয়, অর্থাৎ উৎক্ষেপণ বেগ 7.88 kms-1 অপেক্ষা কম হয়, তবে তা উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করবে এবং অবশেষে পৃথিবীতে ফিরে আসবে [চিত্র ৭.১৮-এ (ক)]।

(২) যদি  <math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><msup><mi>v</mi><mn>2</mn></msup><mo>=</mo><mfrac><mrow><msub><msup><mi>v</mi><mn>2</mn></msup><mi>E</mi></msub></mrow><mn>2</mn></mfrac></math> -হয় অর্থাৎ উৎক্ষেপণ বেগ 7.88 kms-1 হয়, তবে বস্তুটি বৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে এবং চাঁদের মত উপগ্রহে পরিণত হবে [চিত্র ৭.১৮-এ (খ)।

৩) যদি  <math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><msup><mi>v</mi><mn>2</mn></msup><mo>></mo><mfrac><mrow><msub><msup><mi>v</mi><mn>2</mn></msup><mi>E</mi></msub></mrow><mn>2</mn></mfrac></math>   কিন্তু <VE2 হয়, অর্থাৎ উৎক্ষেপণ বেগ 7.88 kms-1 হতে 11.2 kms-1 এর মধ্যে থাকে, তবে পৃথিবীকে একটি ফোকাসে রেখে তা উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে থাকবে [চিত্র ৭.১৮-এ (গ)]।

(৪) যদি v =VE হয়, অর্থাৎ উৎক্ষেপণ বেগ 11.2 kms-1 অর্থাৎ মুক্তি বেগের সমান হয়, তবে বস্তুটি একটি অধিবৃত্ত পথে পৃথিবী পৃষ্ঠ ছেড়ে যায় এবং তা পৃথিবীর আকর্ষণ ক্ষেত্র অতিক্রম করে বাইরে চলে যাবে [চিত্র ৭.১৮-এ (ঘ)]।

(৫) যদি V>VE হয়, অর্থাৎ উৎক্ষেপণ বেগ মুক্তি বেগ অপেক্ষা বেশি হয়, তবে বস্তু পরাবৃত্ত পথে পৃথিবী-পৃষ্ঠ ছেড়ে যায় এবং তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসে না [চিত্র ৭.১৮-এ (ঙ)]।

Content added || updated By
Promotion